নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার খাতা কেনায় অনিয়ম

শিক্ষার্থী সংখ্যার চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারণ হয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ব্যবহারের জন্যে কাগজের পরিমাণ। সেখানে চাহিদা জানায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর। এই চাহিদা ও কেনার প্রক্রিয়া ঘিরেই রয়েছে অনিয়ম এবং ব্যবসার অভিযোগ। সম্প্রতি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনার প্রমাণ মেলে। এর সত্যতাও পাওয়া গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে।

খাতার চাহিদা প্রেরণ, টেন্ডার প্রক্রিয়া, ক্রয় থেকে মজুতকরণ ও বিতরণের হিসাব নিয়ে অনুসন্ধানে আরটিভি অনলাইনের হাতে আসে ভয়ঙ্কর চিত্র। যেখানে সংঘবদ্ধ কয়েকজন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসনও তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কেবল তাই নয়, তদন্ত শেষে জমা দিয়েছেন প্রতিবেদন।

তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রয়োজনের থেকে বেশি চাহিদা প্রেরণ, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা, ক্রয়, ছাপা, মজুতকরণ, বিতরণ ও সংরক্ষণে সংশ্লিষ্টদের অবহেলা ও অনিয়ম। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুসরণ করে সংশ্লিষ্টদের থেকে তথ্য জানতে চাইলে সেখানেও বেশ অমিল।

সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নির্মল চন্দ্র সাহা ২০২১ সালের ২৮ জুন ৭০ হাজার মূল উত্তরপত্র ও ৭০ হাজার অতিরিক্ত উত্তরপত্রসহ আরও ২৩টি উপাদান চাহিদাপত্র অনুযায়ী গ্রহণ ও মজুত করেন। পরবর্তীতে একই বছরের ৫ সেপ্টেম্বর নির্মল চন্দ্র সাহার চাকরিকাল শেষ হওয়ায় ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে যোগদান করেন আবদুল হালিম।

যোগদানের ৩ মাসের মাথায় ৮ ডিসেম্বর ২০২১ এ ১ লাখ উত্তরপত্রসহ ২০টি উপাদান চেয়ে নমুনা ছাড়া চাহিদা প্রেরণ করেন তিনি। যেখানে চাহিদা প্রেরণের ৬ মাস পূর্বে ৭০ হাজার উত্তরপত্র মজুত করে দপ্তরটি।

বিশ্ববিদ্যালয়টির ২৪টি বিভাগের চাহিদা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বছরে ৩৫ হাজারের কাছাকাছি উত্তরপত্রের প্রয়োজন পড়ে। যেখানে প্রতিবছর দপ্তরটি সর্বনিম্ন ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ পর্যন্ত চাহিদা প্রেরণ করে এবং তা ক্রয়েরও অনুমোদন পায়। কিন্তু সেই উত্তরপত্রের ব্যবহার ও মজুতের সঠিক হিসাব দেখাতে পারে না দপ্তরটি।

ছয় মাসের মাথায়ই আবার উত্তরপত্রের চাহিদার বিষয়ে জানতে চাইলে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) আবদুল হালিম বলেন, আমি পূর্বের আহ্বান কিংবা মজুতের বিষয়ে জানতাম না। আমাকে জানানোও হয়নি। চাহিদা সৃষ্টি হওয়ায় ক্রয়ের জন্যে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর তা সংরক্ষণের সঠিক হিসাব রাখতে কাজ করছি।

তবে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) আবদুল হালিমের এমন মন্তব্যের সত্যতা পায়নি তদন্ত কমিটি, যা তাদের (তদন্ত কমিটি) প্রতিবেদন পড়ে জানা যায়। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ও বিভাগগুলোর চাহিদা অনুযায়ী ৭ হাজার ২৩২ জন শিক্ষার্থীর পরীক্ষার জন্যে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার উত্তরপত্রের দরকার। যেখানে প্রয়োজনের চেয়ে কখনো দ্বিগুণ ও কখনো ৩ গুণ চাহিদা প্রেরণ করে তা ক্রয় করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। এই প্রক্রিয়াটিকে অনিয়ম ও দুর্নীতি হিসেবে আখ্যা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউই কোনো রকমের নেগেটিভ নোট জানায়নি এই কার্যক্রম নিয়ে। যেখানে রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও প্রকিউরমেন্ট অফিসারকে এই কার্যক্রমের জন্য দায়ী করেছে তদন্ত প্রতিবেদন। এ ছাড়া এই সিকিউরিটি পেপার ক্রয়ের টেন্ডার রেজিস্ট্রার করতে পারে না বলেও মন্তব্য উঠে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে।

পরীক্ষার খাতাকে সিকিউরিটি প্রিন্টিং বলা হলেও তা স্পষ্টভাবে কারও দায়িত্বে রাখা হয়নি অর্থবিধিতে। তবে সাধারণ ছাপার এখতিয়ার রেজিস্ট্রারের আছে বলে উল্লেখ রয়েছে বিধিতে। এটিকে ইচ্ছে করেই গলদ রাখা হয়েছে বলে মন্তব্য একাধিক শিক্ষকের।

এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে কলা অনুষদের একজন শিক্ষক বলেন, ঈদের আর বৈশাখের কার্ড ছাপানোকে সাধারণ মুদ্রণ বলা যায়। তবে পরীক্ষার খাতা অবশ্যই সাধারণ মুদ্রণ নয়, এটি ভর্তি পরীক্ষার মতোই সিকিউরিটি প্রিন্টিংয়ের আওতায় থাকবে। এটি নিয়ে অস্পষ্টতা অবশ্যই পরিকল্পিত। এই বিধি নিয়ে কথা বলতে চাননি অর্থবিধি প্রণয়নে কাজ করা অর্থ দপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম।

অন্যদিকে পরীক্ষার খাতাকে অবশ্যই সিকিউরিটি প্রিন্ট হিসেবে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার কৃষিবিদ ড. হুমায়ুন কবীর। তবে বিধি অনুযায়ী তা করতে না পারার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, বিধির কোথাও লেখা নেই এই সিকিউরিটি প্রেসের টেন্ডার রেজিস্ট্রার করতে পারবে না। তবে সিকিউরিটি প্রেসের টেন্ডার রেজিস্ট্রার করতে পারবে এমন কোনো বিধিরও উল্লেখ নেই।

অর্গানুগ্রাম অনুযায়ী প্রকিউরমেন্ট পদটি পরিকল্পনা ও ইঞ্জিনিয়ার দপ্তরের আওতায় থাকার কথা থাকলেও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পদটি রয়েছে রেজিস্ট্রার দপ্তরের আওতাধীন, যা নিয়মেরও লঙ্ঘন।

উত্তরপত্র ক্রয় ও মুদ্রণ কাজে অর্থনৈতিক অস্বচ্ছতার প্রমাণও পাওয়া যায় ক্রয় প্রক্রিয়ায়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, কর্ণফুলী পেপার মিল থেকে পেপার ক্রয়ের পর তা বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা-নেওয়া, লোডিং-আনলোডিং দেখিয়ে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৫০ হাজার টাকা, যা প্রত্যেকবার ক্রয়েই ধরা হয়। নথিতে আনা-নেওয়া, লোডিং-আনলোডিং বাবদ ব্যয় দেখানো হলেও তা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে দেখা যায়নি। এমনকি তা স্টোরেও নথিভুক্ত করা হয়নি।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পেপার আনার কথা বলেন প্রকিউরমেন্ট অফিসার আহসানউল্লাহ রাসেল এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. লিয়াকত হাসান। এই পেপার আসার কথা অস্বীকার করেছেন স্টোর অফিসার নাজমুল হাসান।

এ ছাড়া টেন্ডার আহ্বান করার পূর্বেই এম এস ত্বকী এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় পরীক্ষার পেপারসামগ্রী এনে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়টি। প্রশ্ন থাকে অর্ডার পাবার পূর্বেই কীভাবে সাপ্লাই করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।

সম্পর্কিত পোস্ট

Leave a Comment

* বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরসেভেন.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।