আগামী বছরের নতুন পাঠ্যবই লেখা ও মুদ্রণ নিয়ে সংকট তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিক স্তরের সব বইয়ের দরপত্র দেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির কাজের দরপত্রও হয়েছে। কিন্তু দরদাতারা সরকার নির্ধারিত প্রাক্কলিত রেটের চেয়েও অনেক কম টাকায় বই ছাপানোর দর হেঁকেছেন। এর ফলে আগামী বছরও শিশুদের হাতে নিম্নমানের বই যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই লেখার কাজ এখনো শেষ হয়নি। তবে এ দুই শ্রেণির বইয়ের মুদ্রণকাজ কবজায় নিতে এরই মধ্যে দরদাতাদের একটি অংশ বিভিন্ন ধরনের তৎপরতা শুরু করেছে। এর মধ্যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কর্মকর্তাদের ওপর চাপ তৈরি এবং পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার মতো তৎপরতাও আছে। এই অংশের সঙ্গে সংস্থাটির চিহ্নিত কয়েক কর্মকর্তাও গাঁটছড়া বেঁধেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, এ নিয়ে বৃহস্পতিবার একটি সংবাদ সম্মেলন হয়েছে। তাতে নির্দিষ্ট দুটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে সক্ষমতার শর্তে ছাড় দেওয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছে। পাশাপাশি এনসিটিবি চেয়ারম্যান এবং উৎপাদক নিয়ন্ত্রকের অপসারণ দাবি করা হয়েছে।
মুদ্রাকররা জানিয়েছেন, বিনামূল্যের পাঠ্যবই মুদ্রণ নিয়ে এবার প্রথমে এনসিটিবির ভেতরে একটি অংশ সক্রিয় হয়। তারা বাজারদরের চেয়ে বেশি প্রাক্কলিত দর (যে দরে সরকার বই ছাপতে চায়) নির্ধারণ করে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর সিন্ডিকেট চাপের মুখে পড়ে। বিপরীত দিকে মুদ্রাকরদের একটি অংশ প্রাথমিক স্তরের বই প্রাক্কলিত দরের চেয়ে প্রায় ২০ শতাংশ কম দামে কাজ নেয়। এ কারণে অপর অংশ বঞ্চিত হয়। এরপর যখন মাধ্যমিকের দরপত্র আসে, তখন বঞ্চিত গ্রুপ আগের গ্রুপের চেয়ে আরও কম দামে কাজ বাগিয়ে নেয়। কিন্তু দ্বিতীয় গ্রুপ এতই কম দাম দিয়েছে যে, নিউজপ্রিন্টেও বই দেওয়া দুষ্কর হবে বলে খোদ মুদ্রণসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এভাবে ৩৩ কোটি বইয়ের অধিকাংশের দরপত্র শেষ হয়ে যায়। এতে দেখা যায়, অধিকাংশ কাজ ৫-৬টি বড় প্রতিষ্ঠান পেয়েছে। বিপরীত দিকে বহু বছর এনসিটিবির মুদ্রণকাজ নিয়ন্ত্রণকারী বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ২-৩ বছরের ধারাবাকিতায় এবারও খুব কম কাজ পেয়েছে। আবার প্রতিযোগিতায় দাম কমে যাওয়ায় কেউ কেউ কাজই পায়নি। বর্তমানে বাকি আছে অষ্টম-নবম শ্রেণির দরপত্র। এখন এ দুই শ্রেণির কাজ কবজায় নিতে উভয় পক্ষে শুরু হয়েছে দ্বন্দ্ব। ফলে সব মিলে ভেতর ও বাইরের গ্রুপ সংস্থাটিতে অস্থিরতা তৈরি করছে। মুদ্রাকরদের এই দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এসেছে বৃহস্পতিবার। তারা মুদ্রণ শিল্প সমিতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, অগ্রণী এবং কচুয়া নামের দুই প্রতিষ্ঠানকে সক্ষমতার বেশি কাজ দেওয়া হয়েছে। কাজ দিতে তাদের জন্য সক্ষমতার আলাদা শর্ত করা হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি গত বছর বিলম্বে বই সরবরাহ করে। কিন্তু এর বিচার করা হয়নি। এর নেপথ্যে এনসিটিবি চেয়ারম্যান এবং উৎপাদন নিয়ন্ত্রক সহযোগীর ভূমিকায় আছেন। এবারও ওই দুই প্রতিষ্ঠানকে বেশি কাজ দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানটি সময়মতো কাজ শেষ করতে পারবে না এবং দেরিতে বই যাবে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, সরকারি বই মুদ্রণের কাজ নিয়ে আগ্রহীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সব সময়ই ছিল। তাতে কখনোই এনসিটিবি জড়ায় না। বিদ্যমান ব্যবস্থায় কাউকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অসত্য এবং শর্ত শিথিল বা প্রত্যাহারের অভিযোগ অমূলক। তিনি আরও বলেন, মেশিনের উৎপাদন সক্ষমতাসংক্রান্ত অভিযোগ সঠিক নয়। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলার রায় আছে। সেটি অনুসরণ করা হয়েছে।
আর অগ্রণী প্রিন্টিংয়ের সত্ত্বাধিকারী কাওসারুজ্জামান অভিযোগ প্রসঙ্গে জানান, দরপত্র নিয়ে তাকে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিনি অনৈতিক পথে হাঁটেননি। শুধু তাই নয়, ৩-৪ বছর ধরে চিহ্নিতরা তাকে একই ধরনের প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন, যা তিনি উপেক্ষা করায় তাকে টার্গেট করা হয়েছে। এই খাতে কে বা কারা সিন্ডিকেট করে সরকারের অর্থ লুটে নেয়, তা গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টরা জানেন। তাছাড়া সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ব্যক্তিদের অনেকেই বিলম্বে গত বছর বই সরবরাহ করেছেন। এতেই প্রমাণিত হয়, সিন্ডিকেটে না যাওয়াই তার অপরাধ। একই ইস্যুতে সমিতির নেতারা ১২ জুনও এনসিটিবির চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তখনও উল্লিখিত অভিযোগ করেন তারা। এনসিটিবি চেয়ারম্যান জানান, এ পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নমানের বই মুদ্রণকারী এবং সরবরাহের অনুমতি দাতাকে চিহ্নিত করতে কাজ চলছে। মাঠ পর্যায় থেকে তথ্য এলে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে। এর ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।