নারী ও শিশুরা বিচার পায় না

২০০৭ সালের এক সন্ধ্যায় ঢাকার প্রান্তে আত্মীয়ের বাড়ি থেকে ফিরছিল ১৩ বছরের একটি মেয়ে। পরিচিত দুজন তরুণ তাকে ডেকে নিয়ে সারা রাত আটকে রেখে ধর্ষণ করেন। এই অভিযোগে মায়ের এজাহারে মামলা হয়। ডাক্তার ধর্ষণের আলামত পেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ এক আসামির হদিস বের করতে না পারায় তিনি অব্যাহতি পান। অন্যজন প্রায় আট বছর বিচার চলার পর সাক্ষীর অভাবে খালাস পান। মেয়েটির পরিবার বলছে, দুজনই এখনো এলাকায় আছেন।

২০১৪ সালের ২৪ নভেম্বর বিকেলে ভাটারা এলাকায় বাড়ির পাশের দোকানে গিয়েছিল নয় বছরের মেয়েটি। বাবা পরদিন কাছের এক ডোবায় তার বস্তাবন্দী লাশ পেলেন। মেয়েটিকে কেউ ধর্ষণ করার পর গলা টিপে মেরেছিল। পরপর ছয়জন পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা মামলাটির তদন্ত করেন। চারজন গ্রেপ্তারও হয়। কিন্তু সর্বশেষ কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে তাদের অব্যাহতি চান। তিনি লেখেন, আগের তদন্তে অবহেলার কারণে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেননি। মেয়েটির বাবা এই প্রতিবেদনে নারাজি দিয়েছেন।

শ্যামলীর ১৩ বছরের পিংকীকে উত্ত্যক্ত করতেন এলাকার দুই যুবক। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি পাড়ার ওষুধের দোকানে তাঁরা মেয়েটির হাত ধরে টানাহেঁচড়া করেন, চড়-থাপ্পড় মারেন। ঘরে ফিরে পিংকী আত্মহত্যা করে, কারণটা চিরকুটে লিখে যায়। অভিযুক্ত দুজন গ্রেপ্তার হয়ে বছর না ঘুরতেই জামিন পেয়েছেন। সাড়ে সাত বছর ধরে বিচার চলছে। সাক্ষ্য দিয়েছেন শুধু তিনজন আত্মীয়।

পিংকীর পরিবার মধ্যবিত্ত। বাকি দুটি নিম্নবিত্ত। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে করা এই মামলাগুলোর বিচার হচ্ছে একই নামের ট্রাইব্যুনালে।

ঢাকা জেলার পাঁচটি ট্রাইব্যুনালে আসা গুরুতর ছয়টি অপরাধের মামলা নিয়ে প্রথম আলোর প্রায় দেড় বছরের অনুসন্ধান বলছে, বিচারের পরিস্থিতি এ রকমই। পুলিশ আসামিদের খুঁজে পাচ্ছে না অথবা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাচ্ছে না। পুলিশ আর সরকারি কৌঁসুলিরা (পিপি) সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করে মামলা জিততে পারছেন না। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের জন্য হত্যা, যৌতুকের জন্য হত্যা, আত্মহত্যায় প্ররোচনা আর যৌন পীড়নের মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রেও না।

ট্রাইব্যুনালগুলোর বিচারিক নিবন্ধন খাতা থেকে প্রথম আলো এই ছয় অপরাধে ২০০২ থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আসা ৭ হাজার ৮৬৪টি মামলার প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করেছে। তখনো পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়েছিল ৪ হাজার ২৭৭টি মামলা। সাজা হয়েছিল মাত্র ১১০টি মামলায়। অর্থাৎ বিচার হয়েছিল ৩ শতাংশের কম ক্ষেত্রে। বাকি ৯৭ শতাংশ মামলার আসামি হয় বিচার শুরুর আগেই অব্যাহতি পেয়েছে, নয়তো পরে খালাস হয়ে গেছে।

মামলাগুলোর বেশির ভাগ থানায় করা, কয়েক শ মামলা হয়েছে সরাসরি ট্রাইব্যুনালে। সব কটিরই তদন্তের ভার পুলিশের। তদন্তে অবহেলা, গাফিলতি ও অদক্ষতা থাকে। আদালতে সাক্ষী আনা আর সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে পুলিশ আর পিপিদের অযত্ন ও গাফিলতি থাকে। ভুক্তভোগী পক্ষ হয়রানি আর টাকা খেয়ে মামলা ঘুরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ করে।

সম্পর্কিত পোস্ট

Leave a Comment

* বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরসেভেন.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।